Hot Posts

6/recent/ticker-posts

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা দাও। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

 আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা 

 সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের যেমন একটা পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও তেমনই একটা পারস্পরিক সম্পর্ক দেখা যায়। আধুনিক পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। নিজেদের অস্তিত্বের কারণে আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রগুলোকে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। রাষ্ট্রগুলির এই পারস্পরিক সম্পর্ককে সাধারণভাবে 'আন্তর্জাতিক সম্পর্ক' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা 

আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছে মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। অবশ্য বহু আগে অনেক বিখ্যাত লেখক তাদের রচনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মৌলিক চিন্তাভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চীনের মেনশিয়াস, ভারতের কৌটিল্য, ইতালির মেকিয়াভেলি প্রমুখ।

 1. জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: পন্ডিতের মতে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎপত্তির ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। এই কারণে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দকে এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তার আগে রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে ছিল না তা নয়, তবে প্রাচীন গ্রিস, চীন, ভারত মিশরে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল তাকে কোনোভাবেই আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলা যায় না। যাকে আমরা ভূখণ্ড কেন্দ্রিক সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বলছি, তার উৎপত্তি ঘটে 1648 খ্রিস্টাব্দে। ইউরোপের নবজাগরণ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল হলো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই আধুনিক জাতি রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে একে অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তা থেকেই প্রথম আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। তাই জাতির রাষ্ট্রের উদ্ভবের সময় কি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদিকাল বলে অভিহিত করা হয়। 

2. শিল্প বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে যে শিল্প বিপ্লব ঘটে তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অনেকে মনে করেন। শিল্প বিপ্লবের ফলে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটে এবং এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি আরো সহজ হয়। রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে আরো কাছাকাছি চলে আসে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। 

3. নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের 46 বছর পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন দিকে মোড় নেয়। এই সময় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা করে ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে তার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল যাব চলে আসা ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে এই সময়। সারা বিশ্বে একক মহা শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতার মেরুকরণ একমুখী হয় এই সময় থেকে এক মেরু বিশ্ব এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা আগে যেমন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে সীমিত ছিল, এই সময় থেকে তারও পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ককে এত কাল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একমাত্র মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল সেই দৃষ্টভঙ্গির ও বদল ঘটে। যারা রাষ্ট্র নয় অথচ রাষ্ট্রের মতই আন্তর্জাতিক সমাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম সেইসব মহারাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন- সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রভৃতি। 

4. বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল জাতির রাষ্ট্রের আলোচনা কে কেন্দ্র করে। সেখানে এখন বহু বিষয়ের আলোচ্যসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আসলে যে জাতি রাষ্ট্রের প্রভাব এক কালে বিশাল ছিল তাই এখন সিমিত হয়ে এসেছে। অনেকে মনে করেন বিশ্বায়নের যুগে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিক তার বিষয়টি সংকটতা পণ্য। বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি নির্দেশ মেনে রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক নিয়ম-কানুন ঠিক করতে হয়। তাই রাষ্ট্র আর কোনভাবেই আলোচনার মূল কেন্দ্রে থাকতে পারেনা। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নের যুগে অধ্যাপক জোয়ান বেইলী এবং স্টিভ স্মিথ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় যেসব নতুন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থ, পরিবেশগত সমস্যা সমূহ, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসারণ, আঞ্চলিকতাবাদ, বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থ, দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও ক্ষুধা, মানবাধিকার, নারী পুরুষের বৈষম্য প্রভৃতি। 


উপসংহার: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনের প্রক্রিয়া জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভবের যুগে শুরু হলেও বিশ্বায়নের এই যুগে এসে থমকে যায়নি। বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি গতিশীল বিষয়। তাই এর বিবর্তনের প্রক্রিয়া আজও চলমান।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ