Hot Posts

6/recent/ticker-posts

গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির উপর একটি টীকা লেখো। আথবা, গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

গান্ধিজির সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটির উপর একটি টীকা লেখো। আথবা, গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ নীতির অর্থ ও প্রকৃতি

গান্ধীজীর তত্ত্বের একটি অন্যতম প্রধান নীতি হলো সত্যাগ্রহ। পণ্ডিতদের মতে, সত্য প্রতিষ্ঠায় যীশুর আত্মত্যাগ, গৌতম বুদ্ধের অহিংসা ও প্রেমের বাণী এবং রাস্কিন, থোরো ও টলস্টয় এর চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গান্ধীজী সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাটি গড়ে তোলেন। এর পাশাপাশি গীতা ও উপনিষদ সম্বন্ধে তার গভীর অধ্যায়ন ও দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে "নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ" আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তার সত্যাগ্রহ সম্পর্কিত ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছিল। 

অর্থ 

'সত্যাগ্রহ' কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো সত্যের প্রতি আগ্রহ। সত্যাগ্রহ হলো এক সুসংহত জীবন দর্শন, সত্য প্রতিষ্ঠার নৈতিক সংগ্রামে এক নিরস্ত্র প্রতিরোধ। 
                    পণ্ডিতরা গান্ধীজীর সত্যাগ্রহকে ব্রিটিশ রাজের বিপক্ষে চালিত রাজনৈতিক সংগ্রামের এক কৌশল বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, এ হলো অহিংস উপায়ে সংগ্রামের পথ।
 
                    গান্ধীজি তার হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থে সত্যাগ্রহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, "সত্যাগ্রহ হল ব্যক্তির আত্মপীড়নের মাধ্যমে স্বাধিকার অর্জনের এক প্রচেষ্টা।" গান্ধীজীর কাছে সত্যাগ্রহ ছিল সত্য, অহিংসা ও আত্মত্যাগের যোগফল। তার মতে, সত্যাগ্রহ বলতে বোঝায় সকল অন্যায় অবিচার নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে পবিত্র আত্মশক্তির প্রতিরোধ (Satyagraha means the exercise of the purest soul-force against all injustice, oppression and exploitation.)।

গান্ধীজী মনে করতেন, সত্যাগ্রহ হলো যে-কোনো ব্যক্তির এক সহজাত জন্মগত অধিকার। এ শুধু পবিত্র অধিকার নয় পবিত্র কর্তব্যও।

প্রকৃতি 

গান্ধীজি তার রচনায় সত্যাগ্রহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেসব দিকের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[1] আত্মিক শক্তির সংগ্রাম: গান্ধীজীর মতে, সত্যাগ্রহ হলো আত্মিক শক্তির এক সংগ্রাম। এ হলো এমন এক ধরনের সংগ্রাম যেখানে প্রচলিত অর্থে জয় পরাজয় বলে কিছু নেই। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই হল এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য।

[2] নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায় কে অস্বীকার:
গান্ধীজীর অভিমত অনুসারে সত্যাগ্রহ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নয়, এ হলো সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে অস্বীকার করার সংগ্রাম। নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ হলো দুর্বল, ভীরু ও কাপুরুষের অস্ত্র, সত্যাগ্রহ তা নয়, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিপক্ষের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ থাকতে পারে, তবে সত্যাগ্রহে এসবের স্থান নেই। সত্যাগ্রহ হলো সদিচ্ছা ও ভালবাসার সাহায্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়কে অস্বীকার করার এক পদ্ধতি।

[3] জন্মগত অধিকার: গান্ধীজী মনে করতেন, সত্যাগ্রহ হলো মানুষের সহজাত জন্মগত অধিকার (Satyagraha is an inherent birth right of a person)। এ হলো প্রতিটি মানুষের কাছে জন্মগতভাবে এক অর্জিত অধিকার। এই কারণে গান্ধীজী একে পবিত্র অধিকার ও পবিত্র কর্তব্য বলে অভিহিত করেন।

[4] সত্যাগ্রহ ও প্রতিপক্ষ: প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘাতের পথে গিয়ে তার উপর চরম আঘাত হানা সত্যাগ্রহের কাজ নয়। সত্যাগ্রহের পথ আলাদা। সেখানে অহিংসা, প্রেম ও ভালবাসার সাহায্যে প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করাই হলো মূল উদ্দেশ্য। তাই গান্ধীজী সত্যাগ্রহী কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ কাজে অধৈর্য হলে চলবে না। অধৈর্য হওয়ার অর্থ হলো হিংসার আশ্রয় গ্রহণ করা। অন্যায়কারী প্রতিপক্ষকে বিব্রত করার মনোভাব সত্যাগ্রহীর থাকা উচিত নয়।

[5] একটি সৃজনশীল পদ্ধতি: গান্ধীজি মনে করতেন, সত্যাগ্রহ হলো এক সৃজনশীল পদ্ধতি। আপাত দৃষ্টিতে সত্যাগ্রহের কিছু দাবি আদায় করার লক্ষ্য থাকলেও মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের মনে শুভবোধ জাগ্রত করে তার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটানো। এই কারণে সত্যাগ্রহকে একটি সৃজনশীল পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। গান্ধীজি এ কথা স্পষ্ট ভাবে বলেছেন, সত্যাগ্রহ ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, ব্যক্তির নীতি, কর্মপদ্ধতি ও কাজের বিরুদ্ধে।

[6] সত্যাগ্রহ দুর্বলের জন্য নয়: গান্ধীজী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সত্যাগ্রহে দুর্বলতা, ভীরুতা ও কাপুরুষতার কোন জায়গা নেই। তার মতে, যারা ভীরু, কাপুরুষ ও দুর্বল তারা আর যাই হোক সত্যাগ্রহী হতে পারবে না। সত্যাগ্রহ মানে সত্যকে জয় না করা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সামর্থ্য। এই কাজ দুর্বল চিত্ত মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
 
[7] সত্যাগ্রহ ও অহিংসা: সত্যাগ্রহের সঙ্গে অহিংসার একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সত্যাগ্রহী কখনো হিংসাকে প্রশ্রয় দেবে না। সে হবে অহিংসার পূজারী। প্রতিপক্ষকে সে যেমন ঘৃণা করবে না, তেমনি তাকে অতিরিক্ত শ্রদ্ধাও করবে না। এভাবে অহিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করার জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ ছাড়া গান্ধীজি সত্যাগ্রহীদের আত্মপীড়নের জন্য  তৈরি থাকতেও বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন, অন্যায়ের প্রতিরোধ করার জন্য সত্যাগ্রহী আত্মবিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র ভয় পাবে না।

[8] সত্যাগ্রহের বিধি: গান্ধীজি তার রচনায় সত্যাগ্রহের বিধি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, "ভয় কাকে বলে সত্যাগ্রহী জানে না। অতএব প্রতিপক্ষকে বিশ্বাস করতে সে কখনোই শংকিত হবে না। প্রতিপক্ষ তাকে যদি কুড়িবারও ঠকায় , তবুও একুশ বারের বার সত্যাগ্রহী তাকে বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। কারণ সত্যাগ্রহের আদর্শের মূল কথা হলো মানুষের প্রকৃতিতে নিয়ত আস্থা রাখা।

[9] সত্যাগ্রহের কলাকৌশল: গান্ধীজী সত্যাগ্রহের কলাকৌশল এর কোথাও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতগুলি কৌশল হলো-
১. বিবেকের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করা, ২. প্রলোভনের ফাঁদে পা না দেওয়া,৩. বিজয়ীর আধিপত্যের সামনে মাথা নত করা, ৪. জনগণের কাছে যে ব্যাপারগুলি মৌলিক গুরুত্বের, এগুলি কষ্ট শিকারের মধ্য দিয়ে অর্জন করা, ৫. সত্যাগ্রহী উশৃঙ্খলতার কোন জায়গা নেই, ৬. সত্যাগ্রহের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করতে এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত থাকা।

[10] সত্যাগ্রহের চরিত্র: গান্ধীজি বলেছেন, সত্যাগ্রহের চরিত্রই হল সত্যাগ্রহের সৌন্দর্য, এটা আপনা আপনিই আসে, এর সন্ধান করতে হয় না। নিরন্তর সত্যসন্ধান ও সত্যে উপনীত হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্তের নামই সত্যাগ্রহ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ